বাংলাদেশে বর্তমানে পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৪৪টি। এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়া অনেক গ্র্যাজুয়েট দেশ-বিদেশের নামিদামি প্রতিষ্ঠানগুলোয় সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন, সেইসঙ্গে ভুটান বা পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও ‘ওয়ার্ল্ড র‌্যাঙ্কিং টেবিল’-এর প্রথম ১০-এ নেই! এটি যেমন বিস্ময় জাগানিয়া, তেমনি লজ্জা ও অপমানের বিষয় বৈকি।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম শিক্ষার্থীকে অনেকভাবে সাহায্য করতে পারে। সেইসঙ্গে দেশ ও জাতির সম্মান তুলে ধরতে পারে ঊর্ধ্বে। নিজ কিংবা অন্যান্য দেশের চাকরিদাতারা সবসময়ই চান সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে নিজের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিতে। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিংয়ে জায়গা করে নেওয়া বিদ্যাপীঠগুলোর শিক্ষার্থীরা শুধু এভাবেই লাভবান হন না, তারা বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সহপাঠীদের মাধ্যমে নতুন নতুন শিক্ষা যেমন আহরণ করতে পারেন, তেমনি সেসব দেশে অ্যালামনাই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে উচ্চতর গবেষণা কিংবা চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগ পেয়ে থাকেন।

কোনো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিংয়ে জায়গা করে নিতে পারাটা সেই দেশের জন্য যেমন সুনাম বয়ে নিয়ে আসে, তেমনি হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের উৎস। বাংলাদেশ যদি এরকম একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা পরিবেশ তৈরি করতে পারে, তাহলে সুনামের সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও বাড়বে। আর সেজন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিং টেবিলগুলোয় জায়গা করে নেওয়াটা বিশেষ প্রয়োজন।

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিংয়ে জায়গা করে নিতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আগে কীভাবে র্যাঙ্কিং করা হয়, সে সম্পর্কে জানতে হবে। বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠানই এই কাজটি করে থাকে। এর মধ্যে ‘কিউ এস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং অব ইউনিভার্সিটি’, ‘একাডেমিক র‌্যাঙ্কিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ’ এবং ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিং’—এই তিনটি র্যাঙ্কিং সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য এবং সম্মানের। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেষ্টা থাকে, এগুলোতে যাতে জায়গা করে নিতে পারে।

‘কিউ এস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং অব ইউনিভার্সিটি’ ছয়টি ক্যাটাগরিতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে পয়েন্ট দিয়ে থাকে। সেই ক্যাটাগরিগুলো হচ্ছে— (১) একাডেমিক খ্যাতি/সুনাম, (২) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জার্নাল আর্টিকেল সাইটেশন, (৩) শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, (৪) যেসব প্রতিষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইদের চাকরি হয়েছে, সেখানে তাদের সুনাম, (৫) বিশ্ববিদ্যালয়ে কতজন বিদেশি শিক্ষক রয়েছেন তার সংখ্যা এবং (৬) দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থীদের অনুপাত। এর মধ্যে একাডেমিক খ্যাতি বা সুনামের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মোট পয়েন্টের ৪০ শতাংশ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাছাই করা ৭০ হাজার একাডেমিশিয়ানের (শিক্ষক/গবেষক) মধ্যে জরিপের মাধ্যমে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি কেমন, তা যাচাই করে এই পয়েন্ট দেওয়া হয়। এরপর শিক্ষকদের জার্নাল আর্টিকেলগুলো কতবার দেখা হয়েছে এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য কতজন শিক্ষক রয়েছেন, তার অনুপাতের জন্য রাখা হয়েছে সমান ২০ শতাংশ পয়েন্ট। এ ছাড়া বিশ্বের ৩৭ হাজার চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যালামনাইরা কেমন করছেন, তার ওপর রয়েছে ১০ শতাংশ পয়েন্ট। বাকি দুই ক্যাটাগরির জন্য সমান ৫ শতাংশ করে পয়েন্ট বরাদ্দ।

একাডেমিক র‌্যাঙ্কিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ (এআরডব্লিউইউ)’ আগে ‘সাংহাই যিয়াও টং ইনডেক্স’ নামে পরিচিত ছিল। এই র‌্যাঙ্কিং টেবিল মূলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কতটুকু গবেষণা সহায়ক পরিবেশ বিরাজ করছে, তার ওপর গুরুত্বারোপ করে। এআরডব্লিউইউয়ের ক্যাটাগরি ও পয়েন্ট বিন্যাস হচ্ছে (১) নোবেল প্রাইজ এবং ফিল্ডস মেডেলজয়ী অ্যালামনাইয়ের সংখ্যা (১০%), (২) নোবেল প্রাইজ এবং ফিল্ডস মেডেলজয়ী শিক্ষক ও গবেষকের সংখ্যা (২০%), (৩) বাছাই করা ২১টি সাবজেক্ট ক্যাটাগরির জার্নাল সাইটেশনে যেসব শিক্ষক এগিয়ে আছেন তাদের সংখ্যা (২০%), (৪) পরিবেশ ও বিজ্ঞানের ওপর জার্নাল আর্টিকেলের সংখ্যা, (৫) ‘বিজ্ঞান সাইটেশন ইনডেক্স’ ও ‘সামাজিক বিজ্ঞান সাইটেশন ইনডেক্স’-এ প্রকাশিত আর্টিকেলের সংখ্যা (২০%) এবং (৬) শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ফল। এআরডব্লিউইউ প্রতি বছর ১২০০ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ পয়েন্ট পাওয়া ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম র‌্যাঙ্কিং টেবিলে প্রকাশ করে।

‘টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিং’ বলে থাকে তারাই একমাত্র র‌্যাঙ্কিং টেবিল, যারা শিক্ষাদান, গবেষণা, নলেজ ট্রান্সফার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক পরিবেশের সব ক্ষেত্র যাচাই-বাছাই করে থাকে। এই র্যাঙ্কিং টেবিল ১৩টি পৃথক কর্মক্ষমতা সূচক (performance indicator) ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়কে পয়েন্ট দিয়ে থাকে। যেসব ক্যাটাগরিতে যারা পয়েন্ট দেয়, সেগুলোর মধ্যে শিক্ষকতার জন্য রয়েছে ৩০ শতাংশ

পয়েন্ট। এই ক্যাটাগরিতে যেসব বিষয় যাচাই-বাছাই করা হয়, সেগুলো হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুনাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, পিএইচডি-ব্যাচেলর ডিগ্রি শিক্ষার্থী অনুপাত, পিএইডডিধারী শিক্ষকদের অনুপাত এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়। এরপর সমান ৩০ শতাংশ পয়েন্ট বরাদ্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা এবং জার্নাল আর্টিকেলের সাইটেশনের জন্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কতটুকু আন্তর্জাতিক, তার জন্য রয়েছে ৭.৫% পয়েন্ট। এই ক্যাটাগরির মধ্যে রয়েছে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থীর অনুপাত, দেশি ও বিদেশি শিক্ষকের অনুপাত এবং অন্যান্য দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের মাত্রা। সবশেষে ২.৫% পয়েন্ট বরাদ্দ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের অনুপাতে গবেষণাগুলো থেকে কী পরিমাণ আয় হচ্ছে, তা থেকে।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে জায়গা করে নিতে পারে এই র‌্যাঙ্কিং টেবিলগুলোতে? এর উত্তরে বলা যেতে পারে, ‘বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষক, গবেষক, শিক্ষার্থী এবং অ্যালামনাইদের খোঁজ নিতে হবে।’ দেশের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যারা জার্নাল আর্টিকেল প্রকাশ করছেন, তাদের সাইটেশন জানা কর্তৃপক্ষের জন্য খুব একটা কঠিন বিষয় নয়। এজন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা। এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে, আমাদের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিদেশি শিক্ষক নেই বললেই চলে। সরকার এ ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা তৈরি করে দিতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য, যাতে তারা বিদেশি শিক্ষক নিয়োগ দিতে উৎসাহিত হয়। বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে বিদেশের মাটিতে নিজেদের কৃতিত্ব তুলে ধরা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সেই জন্য আফ্রিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন পশ্চাৎপদ দেশগুলো থেকে

মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের নিজ প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসতে আলাদা করে স্কলারশিপের ব্যবস্থা করতে পারে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সেসব দেশে এজেন্ট নিয়োগ করা যেতে পারে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করাতে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এডুকেশন ফেয়ারের আয়োজন করতে হবে বিদেশের মাটিতে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে, যেসব বিদেশি শিক্ষার্থী এরই মধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছেন বা এরই মধ্যে শিক্ষা নিয়ে চলে গিয়েছেন, তারা কে কী অবস্থায় আছেন তার খোঁজ নেওয়া। এ থেকেও কিছু পয়েন্ট পাওয়া যাবে র‌্যাঙ্কিং টেবিলে।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারেরও অনেক কিছু করার আছে। বিমসটেক বা সার্ককে কাজে লাগিয়ে আন্তঃদেশীয় পাঠদান পদ্ধতি চালু করতে পারে সরকার। যেমন—বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় যদি ভারত কিংবা থাইল্যান্ডের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলে যৌথভাবে পাঠদান এবং ডিগ্রি দিতে চায়, তাহলে সরকার তাদের বিশেষ কর রেয়াত বা পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে পারে। বাংলাদেশের ধনী শ্রেণিদেরও সরকার উৎসাহ দিতে পারে, তারা যাতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপ দিতে এগিয়ে আসেন। এখানে আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে, ওইসব দেশের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে কেন আসবে? নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, একজন শিক্ষার্থী যখন উচ্চশিক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখন ছয়টি ধাপে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। সেগুলো হচ্ছে—

প্রথম ধাপ: দেশ না বিদেশের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবে?

দ্বিতীয় ধাপ: বিদেশ পড়তে চাইলে কোন দেশে যাবে?

তৃতীয় ধাপ: বিদেশের কোন শহরে থাকবে?

চতুর্থ ধাপ: কোন বিষয়ে পড়ালেখা করবে?

পঞ্চম ধাপ: কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে।

ষষ্ঠ ধাপ: সে দেশে শিক্ষার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজের সুযোগ কেমন?

বাংলাদেশ সরকার এ ক্ষেত্রে শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যাতে কোনো সেশন জ্যাম না থাকে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য বিশেষ পরিবেশ নিশ্চিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সাহায্য করতে পারে।

যদিও র‌্যাঙ্কিং টেবিলে জায়গা পাওয়াই সবকিছু না। এ ছাড়া আরও অনেক কিছুই আছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উন্নতি সাধন করলে ভালো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে। সেগুলোর মধ্যে কিছু হচ্ছে, ‘শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং এবং মেন্টরিং’-এর ব্যবস্থা করা, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতে উৎসাহ প্রদান করা প্রভৃতি। তবে বিদ্যাপীঠে বিদেশি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের আগমন যে প্রতিষ্ঠান, দেশ ও জাতির জন্য উন্নয়ন সাধন করে, তা বলাবাহুল্য।

লেখক: আইটি উদ্যোক্তা ও ব্লগার